দলিল লেখক ফজলু মুন্সী দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় ছিল। ওমর মাস্টারের ভিটেতে আসতে আসতে বেলা পড়ে গেল। রিক্সায় মুন্সী বলল, আপনে কি পুরা জমি বেচতে চান? হিসাবে আসে ২৮ শতাংশ। কিন্তু ইস্কুল রাখতে চাইলে একটু কম । গভমেন্টের আইনে ইস্কুল চালাইতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ জমি লাগে। নি:সন্তান ওমর মাস্টারের মৃত্যুকালীন ইচ্ছায় টিনের বাড়িটা ভেঙে ইস্কুল ঘর উঠেছে । লম্বা দোচালা ঘর, ভিটেটা মাটির। গ্রামবাসী নিজেরাই জংলা থেকে বাঁশ কেটে দিয়েছে। একজন বিএ মাস্টারকে রাখা হয়েছে। হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালন করে। ওমর মাস্টারের সখ ছিল গ্রামের সব শিশু সরগোলে পড়বে। মেয়েরাও পড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার মৃত্যুর পর ছাত্র ছাত্রী তেমন একটা বাড়ে নি। মুন্সী ফিতা নিয়ে স্কুলের বাউন্ডারীতে টেনে ধরল। বলল, খতিয়ানের মাপে .. মোট জমি ৫৯ শতাংশ। কিন্তু আরএস পর্চায় ৫৮.৫। জমির একটা ভাল পার্টি আছে। এরা দুই সপ্তাহের মধ্যে বড় জমি কিনতে চায় কারা? আছে! রহস্যটা লুকিয়ে মুন্সী মাথা ঝাঁকায়। "আশাবাদী" এনজিওর সেক্রেটারীর সাথে বাদ জুম্মা কথা হইছে । জাগাডা এগোর বিশেষ পছন্দের। এনজিও তো। পয়সা আছে। তিন তলা দালান তুলব। বিদেশী মানুষেরা থাকনের আলদা ঘর তুলব। কত দিব? চাইর লাখ চাইর লাখ! অঙ্কটা শুনে মামুন ঝাঁকি খায়। হ! তয় একডা শর্ত, পুরা জমি চায়। ইস্কুলের ঘর সুদ্ধা কিনতে চায়। না, ইস্কুল বেচন যাইব না, মামুন শক্ত গলায় প্রতিবাদ করে। বেচলে ইস্কুলেরই লাভ। এরা নামকরা এনজিও। খালি ইস্কুলডার নাম ওমর আলি প্রাথমিক বিদ্যালয় বদলায়ে আশাবাদী শিশু বিদ্যালয় করব। সব এনজিও ইস্কুল দেখায়। দেখাইলে তাগো সুবিধা। বানানো পোলার বাপ হইবার চায় - মুন্সী হাসল। যেন খুব হাসির কিছু বলে ফেলেছে। তারপর অভয় দিয়ে বলল, ফরিদুল চাচা, জব্বর মেম্বর, বারেক মিয়া এগো লগে কথা হইছে। সমিতি বেচতে উনাগো আপত্তি নাই। বারেকও কইছে? বারেক সোজা কথার মানুষ। সে সমিতির পুরনো ও সক্রিয় সদস্য। জ্বি উনিই কইলেন যে টেকাপয়সার ন্যায্য ভাগ পাইলে তার অসুবিধা নাই। আপনে রাজি থাকলে হয়। দলিলে মানা নাই। মুন্সী চশমাটা সেটে দলিলের শর্তাবলীতে আঙুল দেখায়। "...দ্বিতীয় পক্ষ জনাব আবদুল মামুন জমির জনাব প্রথম পক্ষ ওমর আলির অবর্তমানে দক্ষিণ প্রান্ত ভোগ দখল করিতে পারিবে। বাকি অর্ধেক সম্পত্তি গ্রামের উন্নতির প্রয়োজনে বিদ্যালয় তথা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকিবে। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবার জন্যনিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী উপদেষ্ঠা কমিটি গ্রহণ করা হইল। তবে যেকোন প্রকার বিবেচনায় দ্বিতীয় পক্ষ আবদুল মামুনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হইবে।" দেখছেন দলিলের প্যাচ । আপনি বলবেন গেরামের উন্নতির প্রযোজনে ইস্কুল এনজিও হাতে হস্তান্তর করতেছেন। বাকিডা গঞ্জের উকিল দিয়া লেখায়া লমুনে। মামুনের কাছে স্কুল বিক্রি অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে দেখতে পায় বেঞ্চে সমস্বরে শিশুরা নামতা পড়ছে। ব্ল্যাক বোর্ডে কিছু লিখে প্রশ্ন করতেই হাত তুলছে কয়েকজন। তারপর ঘন্টা শুনে শিশুরা চিৎকার করে বের হয়ে আসছে। সেই শিশুদের চিৎকার এক বাণ্ডিল নোটের কাছে বিক্রি করবে সে। অসম্ভব। ঠিক পরমূহুর্তে মনে হল এনজি যদি স্কুলের ও সমিতির দায়িত্ব নেয় তাহলে উপকারই হবে। ***** শনিবার-রবি-মঙ্গল-বুধ শহীদুল দোকান দেখে। শহীদুল ময়মুনার দুর সম্পর্কের ভাই। উনিশ বছরের চটপট ছেলে, বিক্রি বাট্টা করার কায়দা জানে। পুরা দোকানের হিসাবনিকাশ মুখে মুখে করতে পারে। দোকানের দুটো চাবির একটা মামুন অন্যটা শহীদুলের কাছে থাকে। শনিবার সকালে অবসরের সুযোগে ঝড়ে ভেঙে পড়া গোয়াল ঘরটা সারাচ্ছিল মামুন। ফুলমতি জেগেছে ভোরে। সে মামুনের ন্যাওটা। মামার দক্ষতা মনযোগে দাড়িয়ে দেখছে এবং নানা প্রশ্ন করছে। ধারালো দা দিয়ে বাঁশ চিড়ে বেতি বানাচ্ছে দু'জন কামলা। মামুন পাটের আঁশ জোড়া দিয়ে দড়ি পাকাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই ফুলমতির সাহায্য নিচ্ছিল। ঠিক সে সময় হন্ত দন্ত হয়ে শহীদুল এসে বলল, ভাইজান, দু:সংবাদ। দীতপুরে মেজ আপার বাচ্চা অইতে রক্ত গেছে খুব। অখন থানা কমপ্লেক্সে। বাচন মরণ আল্লার হাতে। শহীদ উদ্বিগ্ন হয়। অমানবিক তবুও জিজ্ঞেস করে, দোকানে যাইতে পারবি না? না মামুন পকেট হাতড়ে পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে বলে, যা, আমিই দোকান দেখুন নে। শহীদ টাকাটি পকেটে গুঁজে মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঘোমটা ঠিক করে ময়মুনা বের হয়ে আসে। কার লগে কথা কন? নাস্তা খাইবেন না? কার লগে আবার তোমার তালতো ভাইয়ের লগে। হের মেজ বইনের শইল খারাপ। বাচ্চা অওনের সমু রক্ত গেছে। অখন আমারে দোকান খুলন লাগব জরিনার বাচ্চা হইব? কী কন। জরিনার জামাই তো কুয়েত থাকে আড়াই বছর। মাঝখানে আসতেও পারে - তুমি তো ঘরে থাক। জানবা কেমনে। মামুন খেপে যায়। হন হন করে বাড়িতে ঢুকে হ্যাচকা টানে ময়লা জামা নামিয়ে বাইরে আসে। কই যান? হুনেন, কিছু মুখে দিয়া বাইরন - ময়মুনা পিছন পিছন আসে। পথ ছাড়ো। শহীদুলরে খালি সামনে পাই আগে। কি বাড় টা বাড়ছে বইন লয়া তামসা করে। এরে জবাই করুম আইজ। একটু হুনেন। ময়মুনা থামাতে চায়। আমারও তো ভুল অইতে পারে। শহিদ এরুম মিছা কথা কওনের কথা না। *** মামুন সাইকেলটা সড়কে তুলল। আধা মাইল দুরে মূল সড়ক থেকে বাম দিকে সরু রাস্তায় নেমে গেল । তোষা পাটের চারা বড় হচ্ছে । পাতায় পাকা লিচুর মত হালকা লাল রং । হাফেজের মক্তব শুরু হয়েছে। আইল দিয়ে আমপারা বুকে চেপে কয়েকটা শিশুরা সে দিকে হেটে যাচ্ছে। মক্তব ঘর সংলগ্ন জামগাছের নিছে হাতুড়ি দিয়ে মাদক বিরোধী টিনের সাইনবোর্ড লাগাচ্ছিল হাফেজের দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলে । শহীদের সমবয়সী। ঘাড় ঘুরিয়ে মামুনকে দেখে সচকিতে বিড়িটা লুকিয়ে ফেলে সে। মামুন সাইকেল থেকে নামে না। বাম পা মাটিতে রেখে বলে, ওই বুলবুল শহীদুলরে দেখসস? না স্যার, হের নাকি বইনের অসুখ - ছেলেটা হয়তো বিড়ির কারনে হতস্তত: হয় আসে নাই তো অসুখ জানসস কেমনে? আব্বার কাছে পানি ফুঁ নিতে আইছিল হের চাচী *** দোকান বসে মামুন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল স্কুল সহ জমিটা বিক্রি করে দেবে। পাইকারী মালামালের কিনতে গিয়ে প্রায়ই বাকি রাখতে হয় । একই রকম দোকান উঠেছে আরও দুটো। গ্রামে বিদ্যুত আসবে। মোবাইলের ব্যবসাও বাড়বে। একটা কাচের দরজা লাগাতে হবে, বড় দোকান লাগবে। আলমারী লাগবে। মামুন সিগেরেট পান রাখে না। বারেক দোকান সিগেরেট বেচে ভাল ব্যবসা করে। মামুনের মনে হল তার দোকানে সিগেরেট না বেচাতে ধুমপান কিছু একটা কমছে না। তাহলে বিক্রি করলে অসুবিধা কি? বারেক ছোট খাট শক্ত লোক। সম বয়সী হলেও কথায় পাকা। সিদ্ধান্ত নেয় দ্রুত। সমিতিতে টাকা পয়সা উঠাতে সমস্যা হলে বারেক সেটার সমাধান করে। জমি বিক্রিটা নিশ্চিত করতে ঘণ্টা খানেক পর দোকানে বিশ্বস্ত এক চাচাকে বসিয়ে মামুন বারেকের দোকানে গেল। মালয়েশিয়ায় আড়াই বছর কাজ করে শ্রমিক ছাটাই করার সময় বারেক দেশে ফিরে আসে। বিদেশে থেকে তার চলাফেরা বদলেছে। দোকানটা ছোট হলেও রং করেছে। বিকাল থেকে চা বিক্রি করে। টুইনওয়ানে হিন্দী গান বাজায় চড়া শব্দে । ফলে জমজমাট থাকে। লোকজন আড্ডায় বসলে উঠতে চায় না। কি খবর তোর? খবর নাই দোস্ত, মামুন বলল। মরণেরও উপায় নাই। খাঁজ তেলের দাম বাড়ায়া দিছে ময়জুদ্দির কুলু। সমিতির রাইসমিলটা নষ্ট। যাই হউক, মুন্সীর পুত তোরে কিছু কইছে। হ, কইছে - বারেক ব্যাপারটা জানে। তর কি মত, ইস্কুলডা বেচন কি ঠিক হইব। এই ভাঙ্গা ইস্কুল থাইকা কি লাভ? - বারেক সোজাসুজি বলে ফেলল। দেড় মাইল দুরেই আরেকটা ইস্কুল উঠছে। আর হুনছি ছোট তালুকদার তার জমিতেও ইস্কুল খুলবো, দালান উঠব। মাস্টার কাকার লগে এইডা বেঈমানী। আমার তো কিছু নাই। উনি খাওয়াইছে বইলা খাইছি। পড়ছি। আর মরনের সময় বিশ্বাস কইরা জমি দিছে আমার নামে। বারেক হা করে বলে, বেঈমানী ভাবলে বেঈমানী। না ভাবলে না। মাস্টর যখন ইস্কুল খুলছিল হে কি মরা বাপেরে গিয়া জিগাইছিলো? দুনিয়া দমের খেলা। যে মারা যায় তার আবার ইচ্ছা অনিচ্ছা কি? সহজ সত্যটা মামুন বুঝতে পারছে না বলে। দোকানের ভিতর থেকে বের হয়ে মামুনের পাশে বসল বারেক। বলল, ইস্কুল কমিটি বিষয় না। পয়সা পাইলে বেবাক ঠিক। চাইর লাখের অর্ধেক তুই ল, বাকিডা জুলমত, ফরিদুল, আমারে মিলমিশ কইরা দে আমরা সামলায়ে দিমু। মামুন চুপ করে ভাবছিল যদি স্কুলটা নষ্ট হয়। যদি ছাত্র ছাত্রী গ্রামবাসী ক্ষেপে যায়। আর ওমর মাস্টারের নামটা বদলাতে দেয়া ঠিক হবে না। বারেক তাড়া দেয়, কি ভাবস? বেশী ভালা ভালা না। হো হো করে হাসল সে। আমারে দেখ যে মানুস চিন্তাই করে না হে যাত্রা দেখে, বাইজি নিয়া ফুর্তি করে, আর যে বেশী বুঝে সে পায় টেমা বউ। "টেমা বউ" শব্দ দিয়ে ময়মুনাকে আহত করার চেষ্টাটা বরইয়ের কাঁটার মত বুঝে বিঁধে। মামুন খেপে বলে, কি কইসস? আরেক বার ক। মাগীবাজ কোন জায়গার। মামুনকে খেপতে দেখে উল্টো ঠাণ্ডা হয়ে যায় বারেক। আঙুল দিয়ে দাঁতে লেগে থাকা পান পরিষ্কার করে সে বলে, আরে দোস্ত গোস্বা হইলে কেমন হয়। একটু তামসাও কি করন যাইব না। আমি আসলেই একটা হারামী। খবর আছে। এইবার তিন নম্বর আনতাছি তিন তম্বর! বিস্মিত হয় মামুন। এগুলান কি? বিয়া কি গাছের গোটা? মাইয়ারা কি মানুষ না? বারেক তার মতো ব্যাখ্যা করে, মাইয়া মানুষ সংসারের খুঁটি। এক খুঁটি দিয়া কি ঘর হয়? না। হয় ছাত্তি । একটু বাতাস আইলেই উড়ায়ে লয়া যায়। চাইরদিকে পানি ঢুকে। এর লাইগাই কুরান মজিদের নির্দেশ মুমিনের চাইরটা বিবি । মামুন আজব যুক্তিতে হেসে উঠল। বলল, তুই বাড়িতে দশটা খুটি বসা, আমার শইল ভালা না। আমি উঠলাম নতুন পানির চা ফুটেছে। চিনি বেশী করে দুধের চা এগিয়ে বলে, আরে ব, চাডা খায়া গেলে কি হয়। গরীবের বুদ্ধি দেরিতে ফলে। আস্তে আস্তে বারেক বলতে থাকল দুইডা কাম কর। এক জমিটা বেইচা নতুন ঘর তোল। আরেকডা বিয়া কর। দুধে আলতা মাইয়া আছে. অল্প বয়স, ভারী শইল - দেখলে তোর পছন্দ হইবই। বৈকালে ল যাই। আরে জিনিস দেখলেই কি কিনন লাগব, দেখতে কি মুশকিল? মামুনের মনে হয় খিদে পেয়েছিল। অস্বস্থিতে সুরুৎ সুরুৎ করে চা খায়। বারেকের কথাগুলো তত খারাপ লাগে না। কিন্তু তার বউকে নিয়ে ভাবে। আবার কি চিন্তা করস? ভাবীজানে চোখের পানি? ঘরে সতীন তুলতে দিব না? হেইডা সামলানির বুদ্ধি আছে। মনে রাখিস লোহা লাল থাকলে কামারে পিটায়, আর যোয়ানি থাকতে মর্দে বিয়া করে। আকাশে একটুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। বাজারের উপর দিয়ে কেউ যেন একটু ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সুন্দর ঘুড়িটা বার বার ছিঁড়ে যেতে চায়। বারেকের কথাগুলো আজব। চা শেষ হয়। বিস্কুটের স্বাদটা মামুনের খুব চেনা লাগে।এই বিস্কুট পাইলি কই? এডি তো বর্ডারের থন আনাইছিলাম আমি? আরও আছে। চস্কামস্কার প্যাকেট দেখালো বারেক। এডি তোর দোকানেরই। শহীদুল দিয়া গেছে। কইল অর্ধেক পয়সা দিলে চলব। শহীদ! কবে? গতকালও বিস্কুট চিপসের হিসাব মিলে নাই। হে তো মাঝে মইধ্যে আসে। আগেও এগুলান দিসে? - মামুন তার দোকানের চুরির বিষয়টা বুঝতে চায়। ক্যান? পোলাডা খুব ভালা। কথা মত চলে। সেলাম কায়দা জানে। বারেকের মনে যে শহীদুলের জন্য আলগা স্নেহ তা মামুনের বুঝতে বাকি থাকে না। |